Resource Article



সাক্ষাৎকার
দ্বিতীয় তৃতীয় প্রজন্মের কিছু ব্যাংক কদিন পর হয়তো দেউলিয়া হতে শুরু করবে

. এম কবীর হাসান অর্থনীতিবিদ কনসালট্যান্ট। অর্থ পুঁজিবাজার, ইসলামিক ফিন্যান্স, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, করপোরেট ফিন্যান্স, বিনিয়োগ, ব্যাষ্টিক-সামষ্টিক অর্থনীতি প্রভৃতি তার আগ্রহের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতিতে স্নাতক স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন সেখানকারই ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়ন্সে। পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি), আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংক (এএফডিবি), অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সেস (ওআইসি), ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তার রচিত একাধিক গ্রন্থ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। সম্প্রতি দেশে এলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা, ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্ট (সংশোধন), ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারি, ইসলামী ব্যাংকিং, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনা, ঋণ প্রদান, অবৈধ অর্থসহ নানা বিষয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন এম এম মুসা


এত দিন বলা হচ্ছিল বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছরে সেটি দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে খবর মিলছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পর সম্প্রতি কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকেও কেলেঙ্কারির ঘটনা আমরা লক্ষ করলাম। সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
এটা ঠিক, আমাদের রেগুলেটরি দিক এখনো শক্তিশালী। আর্থিক খাত সংস্কারে এখানে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলো প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। তবে সমস্যা হয়েছে, এগুলোর প্রয়োগ হয়নি সঠিকভাবে। দায়িত্বে যারা আছেন, তারাও বিষয়টি ঠিক সেভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। এজন্য আমি বরাবরই বলে এসেছি, আমাদের পেশাদারিত্ব দরকার। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে উচ্চপর্যায়ে সমস্যা ছিল অনেক আগে থেকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কথাই ধরুন। গভর্নর সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ব্যাংকিং সেক্টরে তার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তারপরও তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। এটা করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। আওয়ামী লীগে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাদের ব্যাংকিং, ফিন্যান্স ম্যাক্রো ইকোনোমিক্স ব্র্যাকগ্রাউন্ড আছে। তাদের কাউকে পদে নিয়োগ দেয়া হলে ভুল কম হতো। শেয়ারবাজারে মার্জিন লোন নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হয়েছে, এর দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এড়াতে পারে না। তাই আমি বলব, পেশাদারিত্বের অভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে ছাড় দেয়া দুটিই সমস্যার মূল কারণ। রাজনৈতিক কারণে ব্যাংকিং খাতে ছাড় দেয়ার ফল আমরা এখন দেখতেই পাচ্ছি। তবে সমস্যা শুধু আওয়ামী লীগের নয়, অন্য দলগুলোর মধ্যেও কমবেশি রয়েছে। সমস্যা হলো, নৈতিকতা বোধ জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে আমাদের মধ্যে। সামান্য কিছু টাকা চুরি করলে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি; কিন্তু ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ধরনের রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে ছোটখাটো দুর্নীতি যারা করে, তাদের নিরুত্সাহিত করা যাবে না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এখানে দুর্নীতি আগেও ছিল। তবে আর্থসামাজিক বাস্তবতার কারণে এর আঙ্গিকে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে এখন। তাদের বিস্তৃতি ঘটেছে বেশি। সে কারণে অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা
বিষয়গুলো কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটেই ধরা পড়েছে। প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন?
এটা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। বিবেচনায় বলা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন নয়। অনেক বছর থেকে এটি আমি বলে আসছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা দরকার। এখনো এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের শাখা। গভর্নরসহ উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়োগে এমন একটি প্রক্রিয়া থাকতে হবে, তারা জবাবদিহি করবে সংসদ বা সুপ্রান্যাশনাল বডির কাছে, যেখানে সরকারের নির্বাহী বিভাগ এর ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে না
এক্ষেত্রে আইনের স্বল্পতা রয়েছে বলে মনে করেন কি?
পুরো আইনটি আমি এখনো পড়িনি। তবে এক অধ্যাপক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আইনেও ফাঁক আছে। কিছু বিধানের ফলে দুর্নীতি আরো উত্সাহিত হবে। লোকজন অসাদুপায়ে টাকা উপার্জন করে ব্যাংকে রাখবে এবং প্রত্যেকবার বাজেটারি প্রসেসের মাধ্যমে সেগুলোকে সাদা করার সুযোগ দেয়া হবে। এখন নাকি আরেকটি বিধান করা হয়েছে, শতাংশ শেয়ার না থাকলেও তারা নমিনি দিতে পারবে। অথবা দুই মেয়াদে থাকার পর সে যদি আরেকজনকে নমিনি দিয়ে যায়, তাহলে যে উদ্দেশে বিধানটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা সফল হবে না। ফলে নতুন নেতৃত্ব আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থেকেই যাচ্ছে
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়ার
কথা ছিল?
হ্যাঁ, শুধু বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) অপসারণ করার ক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেলায় এটিও নেই। বিশ্বব্যাংক আইএমএফের একটি শর্তও ছিল এক্ষেত্রে। তা বোধহয় পূরণ করা হয়নি। আসলে এসব হয়েছে সবকিছুতে রাজনীতি ঢুকে পড়ার কারণে। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ প্রভৃতি কেলেঙ্কারি হয়েছে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায়। কারণ ওসব ব্যাংকের এমডি এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যাদের ব্যাংকিং ব্র্যাকগ্রাউন্ড নেই। তারা যে সবাই দুর্নীতি করেছেন, তা কিন্তু নয়। তারা হয়তো বিষয়টি ভালোভাবে জানেন না। ধরনের পদ পেয়ে কেউ কেউ আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। সমস্যা এখানেই। কাউকে বলতে শুনলাম না, দায়িত্ব আমি পালন করতে পারব না। এজন্য অবশ্য নৈতিক শক্তি দরকার। সেটা তাদের মধ্যে নেই বলেই অবস্থা। স্বীকার করি, বর্তমান নিয়মে কিছুটা অপূর্ণতা আছে। তবে যতটা আছে সেটা যদি ঠিকমতো পালন করা হতো, তাহলেও এক ধরনের সুশৃঙ্খলা বজায় থাকত। কিন্তু আমরা ন্যূনতম মানও বজায় রাখছি না
ব্যাংকিং সেবা প্রদানে উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছি আমরা। তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যটা কোথায়?
আসলে বিষয়টা নির্ভর করছে আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতির ওপর। দেশের মধ্যেই সরকারির তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকে কি আমরা অপেক্ষাকৃত উন্নত সেবা পাই না? বেসরকারি ব্যাংকগুলো জানে, তারা যদি সেবা ঠিকমতো না জোগায়, তাহলে ক্লায়েন্ট অন্য ব্যাংকে চলে যাবে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সারা দেশে যত শাখা আছে, সব বেসরকারি ব্যাংক মিলেও অত শাখা নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেসরকারি ব্যাংকের শাখা নেই, আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের। বিবেচনায় বলা চলে, ব্যাংকিং সেবা বলতে যা বোঝায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোই তা বেশি দিচ্ছে। তাই তারা মনে করছে, যা- করা হোক না কেন, তাদের ক্যাপটিভ ক্লায়েন্ট আছে। তারা অন্য কোথাও যাবে না। এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কাউকে তোয়াক্কা করে না
বিদেশে ব্যাংকে থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে আমি সব কাজ করে ফেলতে পারি। আর অনলাইন ব্যাংকিং চলে আসায় অনেক ক্ষেত্রে আমাকে বাইরে যেতেই হয় না। নগদ টাকা দরকার হলে এটিএম মেশিন থেকেই তা তুলে নেয়া যায়। তাদের ব্যাংকিং সিস্টেম সাংঘাতিকভাবে সফিসটেকেটেড। আমাদের দেশে এটি কল্পনাও করা যায় না। তবে ন্যূনতম যে মানের সেবা জোগানো সম্ভব, সেটি কিন্তু সব ব্যাংকেই থাকা উচিত
এখানে আরেকটি সমস্যা হলো, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনাগুলোও পরিবর্তন হয়ে যায়। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। কারণে আমরা
পিছিয়ে পড়ছি
২০০৭ সালে যখন অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়, তখন আমেরিকার অনেক ব্যাংক সংকটে পড়েছিল। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ওপর এর প্রভাব কিন্তু তেমনটা লক্ষ করা যায়নি। এর কারণ কী?
কারণটা খুব সাধারণ। যে খাতে ঋণ প্রয়োজন নেই, সেখানে অর্থ দিয়েছে মার্কিন ব্যাংকগুলো। কারো লাখ টাকা দামের বাড়ি কেনার সামর্থ্য থাকলেও তাকে লাখ টাকা দামের বাড়ি কিনতে সহায়তা করা হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যক্তি তো মন্দায় পড়বেনই। সমস্যা এখানে সীমাবদ্ধ থাকলে তা মোকাবেলা করা যেত। এটাকে পুঁজি করে সেকেন্ডারি মার্কেটে সৃষ্টি করা হয়েছে অনেক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্ট। এগুলো শুধু আমেরিকা নয়, উন্নত দেশের ব্যাংকগুলোও তা কিনেছে। তাই ওখানে স্থানীয় সমস্যা পরিণত হয়েছে জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক সমস্যায়। আমাদের ব্যাংকগুলো ওই ধরনের বিনিয়োগ করেনি। আমরা যদি তা করতাম, তাহলে আমাদেরও একই অবস্থা হতো। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা ভালো কাজ করেছি। আসলে তা করার মতো ক্যাপাসিটিই আমাদের নেই
আমাদের ব্যাংকগুলোও তো এমন বিনিয়োগ করছে। যত দূর জানা যায়, সিংহভাগ বিনিয়োগই তারা করছে জমি ব্যবসায়। যদি কোনো কারণে ব্যবসায় ধস নামে, তাহলে ব্যাংকগুলোর অবস্থা তো খারাপ হয়ে যাবে...
হ্যাঁ। তবে জমি ব্যবসার মধ্যে পার্থক্য আছে। ব্যবসায় তো উন্নতি হচ্ছে, তাই না? বরং এক্ষেত্রে সমস্যা হলো ঋণ দিয়ে জমির দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটা উত্পাদনশীল কোনো পন্থা নয়। যে জমির দাম লাখ টাকা, তার দাম বেড়ে লাখ টাকা হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এটি তেমন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু ব্যবসার জন্য যদি ঋণ দেয়া হয়, তাতে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হয়, তারা উত্পাদন করেসামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়ে প্রবৃদ্ধিতে। এজন্য খাত দুটিকেও দেখতে হবে আলাদাভাবে। আমাদের রিয়েল এস্টেট ব্যবসাও এখন অনেক বেড়েছে। অনেককে দেখি ঋণ নিয়ে জমি কিনে রাখতে। খাতে কী পরিমাণ ঋণ দেয়া হবে, সে ব্যাপারেও বিধান থাকা উচিত
নিয়মকানুন এখন করা হয়েছে। কিন্তু সেটি ঠিকমতো পরিপালন করা হচ্ছে না। অনেক সময় বিনিয়োগের কথা বলে ব্যাংক নিজেই জমি কিনছে। বিভিন্ন ফাঁকফোকর থাকার জন্যই কী এমনটি করছে তারা?
এর একটা কারণ আছে। একজন ব্যাংকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটা করবেন না। কারণ ব্যাংকে তার ফিন্যান্সিয়াল রেসপনসিবিলিটি আছে। আমানতকারী যেকোনো সময় তার অর্থ তুলে নিতে পারেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলে বাংকগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণ দিতে চায়। কথা হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণ দেয়ার জন্যই ব্যাংক আছে। মন্দার সময়ও অর্থ দিতে হবে
ব্যাংকগুলো নাকি ব্যবসায় অধিক ঋণ দিচ্ছে। এটি ভালো না মন্দ?
কোনো কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিলে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ধস নামবে। আমেরিকায় কমিউনিটি রিইনভেস্টমেন্ট অ্যাক্ট নামে একটি আইন আছে। আমাদের ব্যাংকগুলো সাধারণত ধনীদের ঋণ দেয়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের তারা ঋণ তেমন দিচ্ছে না। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। এটি উত্সাহিত করার জন্য সরকারের যে নীতি আছে, সেটি তারা যথাযথভাবে অনুসরণ করছে না। দেশের ২০ শতাংশ মানুষ, এখানকার ৮০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই যাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়। তাদের কেউ কেউ আবার ব্যাংকের মালিক। কিন্তু যেসব সাধারণ মানুষ অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছে, ব্যাংকে তাদের প্রবেশাধিকার সীমিত। আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেমে এমন একটি নীতিগত পরিবর্তন হওয়া দরকার, যাতে ব্যাংকগুলোবড়, মাঝারি ক্ষুদ্র সব শ্রেণীকেই সেবা দিতে পারে
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এখন কী কী চ্যালেঞ্জ আপনি দেখছেন?
ব্যক্তিগতভাবে আমি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার বিপক্ষে। বলব, এটা ভুল হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমানে যে আর্থসামাজিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, তাতে এতগুলো ব্যাংক ধারণ করার ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই
মার্জার অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট করতে হবে। রাজনীতিক বা ব্যবসায়ীরা ব্যাংকিং ব্যবসায় কেন আসেন? কারণ অন্তত পাঁচ বছর ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার চিন্তা নেই। কারণ যে টাকা তারা বিনিয়োগ করেন, ব্যাংক থেকে তার কয়েক গুণ লুটপাট করতে পারেন। অধিকাংশের উদ্দেশ্যই থাকে এমন। এজন্যই আমি নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার বিপক্ষে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক এটি রিলাকট্যান্টলি দিয়েছে। তারা যে এতটা বোঝে, তাও নয়। আমার মনে হয় আর কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধারণ করার মতো অর্থনৈতিক অবকাঠামো বাংলাদেশের নেই। ধরনের প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বন্ধ করে দেয়া উচিত। আমার ধারণা, দ্বিতীয় তৃতীয় প্রজন্মের কিছু ব্যাংক কয়েক দিন পর হয়তো দেউলিয়া হতে শুরু করবে। তখন তাদের বের হওয়ার পথ কী? পথ কিন্তু নেই। এজন্য তাদের মার্জার অ্যাকুইজিশনের ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। এখানে একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার হলো, প্রতিষ্ঠান যখন আমরা গড়ি, তখন কেউই এর পিতৃত্বের দাবি ছেড়ে দিতে চাই না। আমেরিকা-ইউরোপে কিন্তু এমনটি দেখা যায় না
বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক এখন ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। অনেকে মনে করেন, এটি অপেক্ষাকৃত লাভজনক। এখানে ধারার ব্যাংকের সম্ভাবনা কেমন?
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা খুবই বেশি। আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ৫০ শতাংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করবে। কারণ ইসলামী ব্যাংকের কর্মীরা খুব বেশি ত্যাগী। এটা কারণে নয় যে, তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুসারী। তাদের ইনসেনটিভ ম্যাকানিজমটা অনেক সুন্দর। দেখেছি, ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখার মেসেঞ্জার ৩৫ হাজার টাকা বেতন উত্তোলন করেন; ওই শাখার ম্যানেজারের বেতন ৯০ হাজার টাকা। অন্যান্য ব্যাংকে এটি কি কল্পনা করা যায়? তবে আরো বেশি এগিয়ে যাওয়ার জন্য ধারার ব্যাংকের স্ট্রাকচারে কিছু সংস্কার করতে হবে। নইলে প্রচলিত ব্যাংকগুলোয় যে ধরনের ধস নামার শঙ্কা করা হয়, ইসলামী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও তা ঘটতে পারে। সর্বোপরি তাদের পেশাদারিত্ব আরো বাড়াতে হবে। এখন বাংলাদেশের ২০ শতাংশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং করছে। এগুলো তদারকের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আলাদা একটি বিভাগ খোলা উচিত। রাজনৈতিক কারণে এখন এটি হয়তো হচ্ছে না। তবে এটা এখন সময়ের দাবি
অবৈধ অর্থ নিয়ে আপনার গবেষণা রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি কী?
এর একটা মিউজিক্যাল ক্যারেক্টার আছে। সম্প্রতি পত্রিকায় লক্ষ করলাম, বিদেশে যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। বিদেশে তারা যায় হয়তো বিনিয়োগের জন্য। প্রশ্ন হলো, তারা কেন যাচ্ছে? নিরাপত্তাহীনতা থেকে। অবৈধ টাকার পরিমাণ বাংলাদেশে বাড়ছে। একে কোনো সমাজ থেকে বের করে দেয়া কঠিন। তাই এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শুনলে অনেকে অবাক হবেন, ভারতে অবৈধ টাকার পরিমাণ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। চীনের মতো কমিউনিস্ট দেশও রয়েছে তালিকার ওপরের দিকে। বাংলাদেশে অবৈধ টাকা সৃষ্টির কারণ হিসেবে আমি মনে করি, এর একটা ইন্ট্রা-ডেভেলপমেন্ট বায়াস আছে। ভারতে অবৈধ টাকা অ্যাবসর্ব করার একটা সোসিও ইকোনোমিক ফর্মুলা তৈরি হয়েছে। এটা দেশটির অভ্যন্তরেই বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের টাকা চলে যাচ্ছে অন্য দেশে। এক্ষেত্রে আমাদের মনোভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নইলে দেশ কোনো দিনই দাঁড়াতে পারবে না
আমাদের দেশে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আসছে। বীমা কোম্পানি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। খাতের জনবল ধরে রাখার ক্ষেত্রে কি যথেষ্ট প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে কি?
আমাদের প্রশিক্ষণ সাংঘাতিকভাবে অপ্রতুল। গবেষণা খাতে ব্যয় করতে আমাদের মারাত্মক রকম অনীহা আছে। ব্যাপারটা আমরা বুঝিই না। অনেকে মনে করেন, এটা ফালতু খরচ। ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে আমি সারা বিশ্বে প্রশিক্ষণ দেই। অথচ বাংলাদেশে কথা বললে লোকে হাসাহাসি করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। সে অনুযায়ী আমরা দেশে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারিনি। আর যেগুলো আছে, সেগুলোর মানও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। সমস্যা হলো, এটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না। ভারত, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ কেন এগিয়ে যাচ্ছে? তারা ধরনের অবকাঠামো তৈরি করে নিতে পেরেছে। এটি করতে না পারলে আমরা যে দলকেই ক্ষমতায় আনি না কেন, কেউ কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না
আপনি ২০ শতাংশ লোকের কথা বললেন। এরাই বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, গণমাধ্যমসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। শ্রেণীর কারণেই সমাজে কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে কী?
অবশ্যই। সমাজে যত অস্থিতিশীলতা থাকে, তারা ততটাই সুযোগ পায়। সম্পদ আহরণ, শোষণ শাসনকে তারা স্থায়ী করার সুযোগ পায়। এটা তাদেরই সৃষ্টি। দেশে কি এমন কোনো টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্র আছে, যার মালিক কৃষক? এর পরিবর্তন করা সম্ভব হতো, যদি আমরা সবাই গণতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন হতাম। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও এতটা শক্তিশালী নন। তিনিও কংগ্রেস সিনেটের অনুমোদন ছাড়া কিছু করতে পারেন না। অন্য দেশ আক্রমণ করতে হলেও তাকে অনুমতি নিতে হয়। আর আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীকে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করার মতো কিছু নেই। তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আমাদের কাঠামো পরিবর্তন করা দরকার

অনুলিখন: জাহিরুল ইসলাম

No comments:

Post a Comment

FACEBOOK